সংবিধানের সংজ্ঞা ও গণপরিষদ

সংবিধান কি?

সংবিধান হল একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম ও নীতির সংকলন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ গঠন, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ ও নিয়ন্ত্রন কিভাবে হবে, রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে, জনগণ কি কি অধিকার ভোগ করবে, রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের দায়িত্ব কি হবে তা সংবিধানের মধ্যে উল্লেখ থাকে। আমরা দুই ধরনের সংবিধান দেখতে পাই---

  • লিখিত সংবিধান, যেমন ভারতের সংবিধান
  • অ-লিখিত সংবিধান, যেমন ব্রিটিশ সংবিধান

ভারতের সংবিধান কে রচনা করেছিল?

ভারতের সংবিধান রচনা করেছিল ভারতের গণপরিষদ।

গণপরিষদ কি?

গণপরিষদ হল ভারতের সংবিধান রচনা করার জন্য ভারতের জনগণের প্রতিনিধি দ্বারা গঠিত একটি সংস্থা।

গণপরিষদের গঠনের পটভূমি

  • ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্ট মুভমেন্টের জনক মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রথম সংবিধান রচনার দাবী জনসমক্ষে উত্থাপন করেন।
  • ১৯৩৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সংবিধান রচনার প্রস্তাব গ্রহণ করে।
  • ব্রিটিশ সরকার ১৯৪০ সালের "আগস্ট-প্রস্তাব"(August Offer)-এ সংবিধান রচনার দাবীটিকে সরকারী স্বীকৃতি দেয়।
  • ১৯৪৬ সালে ভারতে আগত ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল ভারতের গণপরিষদ। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের যে চারটি মূল নীতির উপর ভিত্তি করে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল সেগুলি হল--
    • প্রত্যেক প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্য তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে অর্থাৎ প্রতি দশ লক্ষ জনতার জন্য একজন গণপরিষদে আসন পাবে।
    • প্রত্যেক প্রদেশের আসন সংখ্যা সাধারন, মুসলিম ও শিখ এই তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে বিভক্ত হবে।
    • প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সদস্যগণ একহস্তান্তরযোগ্য সমানুপাতিক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রাদেশিক আইনসভাগুলি থেকে নিজ নিজ প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে।
    • প্রিন্সলি স্টেটগুলি থেকে প্রতিনিধি মনোনয়নের পদ্ধতি আলাপ আলোচনার মাধ্যমে স্থির হবে।

গণপরিষদের গঠন

  • ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান অনুসারে 1946 সালের জুলাই মাসে গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প
  • ১১টি ব্রিটিশ-শাসিত প্রদেশ থেকে ২৯২ জন(২১০ জন সাধারণ, ৭৮ জন মুসলিম, ৪ জন শিখ), দেশীয় রাজ্য গুলি থেকে ৯৩ জন এবং চীফ কমিশনার শাসিত প্রদেশ(দিল্লী, আজমীঢ়-মারওয়া, কুর্গ ও বালুচিস্তান) গুলি থেকে ৪ জন নিয়ে মোট ৩৮৯ জন সদস্যের ভারতীয় গণপরিষদ গঠিত হয়।
  • ব্রিটিশ-শাসিত প্রদেশগুলির আসন বণ্টন নিম্নলিখিতভাবে হয়েছিল---
  • প্রদেশ সাধারণ মুসলিম শিখ
    মাদ্রাজ ৪৫
    বোম্বাই ১৯
    উত্তরপ্রদেশ ৪৭
    বিহার ৩১
    কেন্দ্রীয় প্রদেশ সমূহ ১৬
    ওড়িশা
    পাঞ্জাব ১৬
    উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ
    সিন্ধ
    বাংলা ২৭ ৩৩
    অসম


    যদি আমরা দলের ভিত্তিতে আসন বণ্টন দেখি তাহলে আমরা দেখতে পায়- জাতীয় কংগ্রেস ২০৮টি, মুসলিম লীগ ৭৩টি, ইউনিওনিষ্ট ১টি, ইউনিওনিষ্ট মুসলিম ১টি, ইউনিওনিষ্ট তফশিলি জাতি ১টি, কৃষক প্রজা ১টি, তফশিলি জাতি ফেডারেশন ১টি, শিখ(অকংগ্রেসী) ১টি, কমিউনিস্ট ১টি ও নির্দল ৮টি আসন পেয়েছিল।

গণপরিষদের অধিবেশন

  • গণপরিষদটি মোট 165 দিন জুড়ে এগারটি অধিবেশন বসে।

গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন

  • 1946 সালের 9 ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় নয়াদিল্লির সংবিধান হলে , যা এখন সংসদ ভবনের কেন্দ্রীয় হল হিসাবে পরিচিত।
  • মুসলিম লীগের সদস্যরা এই অধিবেশনে় যোগদান করেনি।
  • পরিষদের প্রবীণতম সদস্য ডঃ সচিদানন্দ সিনহা গণপরিষদের অস্থায়ী চেয়ারম্যান বা সভাপতি নির্বাচিত হন।
  • পরে ১১ ই ডিসেম্বর ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ গণপরিষদের স্থায়ী চেয়ারম্যান এবং এইচ. সি. মুখার্জি ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। বি. এন. রাও সাংবিধানিক উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন।
  • ১৯৪৬ সালের ১৩ ই ডিসেম্বর পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ভারতীয় সংবিধানের "উদ্দেশ্যেসমূহ সংক্রান্ত প্রস্তাব"(The Objective Resolution) -টি উত্থাপন করেন। ২২শে জানুয়ারি, ১৯৪৭-এর অধিবেশনে এই প্রস্তাব সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়, এবং পরবর্তীকালে এই অংশটি সংবিধানের "প্রস্তাবনা" আকারে লিপিবদ্ধ হয়।
  • গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শেষ হয়—২৩শে ডিসেম্বর, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে।

গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন

  • গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন হয় ২০শে জানুয়ারি, ১৯৪৭ থেকে ২৫শে জানুয়ারি, ১৯৪৭ থেকে।

গণপরিষদের তৃতীয় অধিবেশন

  • গণপরিষদের তৃতীয় অধিবেশন হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে এপ্রিল থেকে ২রা মে ।
  • কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত কমিটি (Union Constitutional Committee)গঠিত হয়, সভাপতি হন-পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু।
  • প্রাদেশিক শাসনতন্ত্র সম্পর্কিত কমিটি (Provincial Constitutional Committee)গঠিত হয়, সভাপতি হন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল।

গণপরিষদের চতুর্থ অধিবেশন

  • গণপরিষদের চতুর্থ অধিবেশন হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জুলাই থেকে ৩১শে জুলাই ।

গণপরিষদের পঞ্চম অধিবেশন

  • গণপরিষদের পঞ্চম অধিবেশন হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই আগস্ট থেকে ৩০শে আগস্ট।
  • ১৯৪৭ সালের ২৯ অগস্ট ড. বি. আর. আম্বেডকরের নেতৃত্বে খসড়া কমিটি গঠিত হয়। ড. আম্বেডকর ছাড়াও এই কমিটিতে আরও ছয় জন সদস্য ছিলেন। কমিটি একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করে সেটি ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বরের মধ্যে গণপরিষদে পেশ করেন।

গণপরিষদের ষষ্ঠঅধিবেশন

  • গণপরিষদের ষষ্ঠ অধিবেশন হয় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারী ।

গণপরিষদের সপ্তম অধিবেশন

  • গণপরিষদের সপ্তম অধিবেশন হয় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা নভেম্বর থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ই জানুয়ারী ।

গণপরিষদের অষ্টম অধিবেশন

  • গণপরিষদের অষ্টম অধিবেশন হয় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মে থেকে ১৬ই জুন ।

গণপরিষদের নবম অধিবেশন

  • গণপরিষদের নবম অধিবেশন হয় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জুলাই থেকে ১৮ই সেপ্টেম্বর ।

গণপরিষদের দশম অধিবেশন

  • গণপরিষদের দশম অধিবেশন হয় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ই অক্টোবর থেকে ১৭ই অক্টোবর ।

গণপরিষদের একাদশ অধিবেশন

  • গণপরিষদের একাদশ অধিবেশন হয় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই নভেম্বর থেকে ২৬শে নভেম্বর।

ভারতের সংবিধানে স্বাক্ষর করার জন্য গণপরিষদের সদস্যরা ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারী পুনরায় সমবেত হয়। এই দিনটি জাতীয় আইন দিবস হিসেবে পরিচিত।

গণপরিষদ ও সংবিধান রচনা

  • গণপরিষদ সংবিধান রচনা করতে ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন সময় নিয়েছিল।
  • খসড়া কমিটি প্রাথমিক পর্বে সংবিধানে যুক্ত করেছিল ৩১৫টি ধারা ও ১৩টি তফশিল (Schedule)।
  • চূড়ান্ত পর্বে খসড়া কমিটি সংবিধানে রাখে ৩৯৫টি ধারা ও ৮টি তফশিল।
  • ভারতীয় সংবিধান গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল ২৬শে নভেম্বর, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে।
  • ভারতের সংবিধান গণপরিষদ কর্তৃক কার্যকর হয় ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫০। সংবিধান প্রবর্তনের স্মৃতিতে ভারতীয়রা প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারি তারিখটি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে উদযাপন করেন।