বায়ুমণ্ডল [Atmosphere]

বায়ুমণ্ডল [Atmosphere]

  • ভূপৃষ্ঠ থেকে ঊর্ধ্বে যে অদৃশ্য গ্যাসের আবরণ পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে, তাকে বায়ুমণ্ডল [Atmosphere] বলে ।
  • পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের প্রভাবে বায়ুমণ্ডল পৃথিবী ছেড়ে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যায় না।
  • সমুদ্রসমতল থেকে প্রায় ১০০০০ কিমি উপর পর্যন্ত এই বায়ুমণ্ডলের অবস্থান।
  • বায়ুমন্ডলের প্রায় ৯৭% ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ কিলোমিটার এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।

বায়ুমণ্ডলের গঠন [Composition Atmosphere] :-

বায়ুমণ্ডলের উপাদানসমূহকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়-

  • গ্যাসীয় উপাদান:
    • নাইট্রোজেন (N2) – ৭৮.০২%
    • অক্সিজেন (O2) – ২০.৭১%
    • কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) – ০.০৩%
    • আরগন (Ar)-
    • অন্যান্য গ্যাসসমূহ (নিয়ন, হিলিয়াম, ক্রিপটন, জেনন, ওজোন, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড)
  • জলীয় বাষ্প – ০.৪১%
  • ধুলিকণা – ০.০১%

বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস

বায়ুমণ্ডলের স্তর দুভাবে ভাগ করা যায়- (১) উপাদান ও রাসায়নিক গঠন অনুসারে স্তর ভাগ এবং (২) প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও উষ্ণতার তারতম্য অনুসারে স্তর ভাগ।

উপাদান ও রাসায়নিক গঠন অনুসারে স্তর ভাগ

উপাদান ও রাসায়নিক গঠন অনুসারে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, যথা:- (১) হোমোস্ফিয়ার এবং (২) হেটেরোস্ফিয়ার ।

সমমণ্ডল (Homo-sphere):-

ভূপৃষ্ঠ থেকে ৮০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত অংশে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উপাদানের রাসয়নিক গঠন, বিশেষত বিভিন্ন গ্যাসের অনুপাত প্রায় একই রকম থাকে । এই জন্য বায়ুমণ্ডলের এই স্তরকে হোমোস্ফিয়ার বলা হয় ।

বিষমমন্ডল (Hetero-sphere):-

বায়ূমণ্ডলের হোমোস্ফিয়ার স্তরের ওপরের অংশে বিভিন্ন গ্যাসের অনুপাত এবং বায়ুমণ্ডলের স্তরগুলো একই রকম থাকে না বলে ভূপৃষ্ঠের ওপরে ৮০ কিলোমিটার থেকে ১০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুস্তরকে হেটেরোস্ফিয়ার বলা হয় ।

প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও উষ্ণতার তারতম্য অনুসারে স্তর ভাগপ্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও উষ্ণতার তারতম্য অনুসারে বায়ুমণ্ডলের সমমণ্ডলকে তিনটি ও বিষমমন্ডলকে তিনটি অর্থাৎ মোট ছয়টি স্তরে ভাগ করা হয়।

ট্রোপোস্ফিয়ার [Troposphere] বা ঘনমণ্ডল:-

  • ভূ-পৃষ্ঠের নিকটমত বায়ু স্তরকে ট্রপোমন্ডল বলে।
  • এ স্তরের গভীরতা মেরু এলাকায় ৮ কিলোমিটার এবং নিরক্ষীয় এলাকায় ১৬ থেকে ১৯ কিলোমিটার।
  • বায়ুমণ্ডলের এই স্তরে বায়ুতে প্রায় ৯০% ধূলিকণা, জলীয় বাষ্প, কুয়াশা, মেঘ প্রভৃতি থাকায় এই স্তরে ঝড়, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, তুষারপাত প্রভৃতি ঘটনাগুলি ঘটতে দেখা যায়, এজন্য ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলকে 'ক্ষুব্ধ মন্ডল' বলে ।
  • ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর ঘনত্ব কমতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে উষ্ণতা। সাধারণভাবে প্রতি ১০০০ মিটার উচ্চতায় ৬.৪° সেলসিয়াস তাপমাত্রা হ্রাস পায়। মধ্য অক্ষাংশে ট্রপোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্ব সীমানায় উত্তাপ -৫৭° সেলসিয়াস থেকে – ৬০° সেলসিয়াস হয় ।
  • ধূলিকণা অবস্থানের কারণে সমগ্র বায়ুমন্ডলের ওজনের ৭৫ ভাগ এ স্তরে থাকে। এখানে বায়ুরচাপ সবচেয়ে বেশি ।

ট্রোপোপজ [Tropopause]:-ট্রোপোস্ফিয়ার এবং স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার- এই দুই বায়ুস্তরের সীমা নির্দেশক সংযোগ স্থলকে ট্রপোপজ বলে । ট্রপোস্ফিয়ার বায়ুস্তর এই অঞ্চলে এসে থেমে যায়, তাই একে ট্রপোপজ বলে । ট্রপোপজের স্তরে বায়ু চলাচল বা তাপীয় ফল তেমন দেখা যায় না, তাই এই স্তরকে স্তব্ধ স্তরও বলে ।

স্ট্রাটোস্ফিয়ার [Stratosphere] বা শান্তমণ্ডল:-

  • ট্রপোমন্ডলের ঠিক উপরেই শুরু হয়েছে স্ট্রাটোমন্ডল। এই স্তর পৃথিবীর ভূমির উপর ১৭ কিমি থেকে শুরু করে প্রায় ৫০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত।
  • এ স্তরের বায়ুতে অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা ছাড়া কোন জলীয় বাষ্প থাকে না। ফলে আবহাওয়া থাকে শান্ত ও শুষ্ক। ঝড় বৃষ্টি থাকে না বলেই এই স্তরের মধ্য দিয়ে সাধারণত জেট বিমানগুলো চলাচল করে।
  • স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডলের মধ্যে উপরের দিকে রয়েছে ওজন (O3) গ্যাসের স্তর, যার ফলে সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত জীবজগতের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি (Ultra Violet Ray)শোষণ করে নেওয়ায় জীবজগৎ ধ্বংশের হাত থেকে রক্ষা পায়।
  • ট্রপোস্ফিয়ারের পরবর্তী বায়ুস্তর স্ট্র্যাটস্ফিয়ারের মধ্য দিয়ে যতই ঊঁচুতে ওঠা যায় ততই উত্তাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং ৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় উত্তাপ সবচেয়ে বেশি (১০° সেলসিয়াস) হয় ।

স্ট্র্যাটোপজ [(Stratopause]:-স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের মধ্যে দিয়ে যতই উঁচুতে ওঠা যায় ততই উত্তাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং (উত্তাপ) ৫০ কিমি উচ্চতায় সর্বোচ্চ (০° সেন্টিগ্রেড) হয় । তবে ৫০ কিমির বেশি উচ্চতা থেকে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা আবার কমতে শুরু করে, অর্থাৎ তাপমাত্রার বৃদ্ধি থেমে যায় বা পজ করে । স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার ও মেসোস্ফিয়ারের মধ্যবর্তী অঞ্চলে তাপমাত্রার স্থিতাবস্থা থাকায় এই অঞ্চলকে স্ট্র্যাটোপজ বলা হয় ।

মেসোমন্ডল (Mesosphere)

  • স্ট্রাটোবিরতির উপরে অবস্থিত বায়ুমন্ডলের তৃতীয় স্তর।
  • Mesosphere সমুদ্রপৃষ্টের ৫০ কিমি থেকে ১০০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত।
  • স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের পরে বায়ুর উত্তাপ আবার ক্রমশ বাড়তে থাকে ।
  • বায়ুমন্ডলের শীতলতম স্তর এটি। ঐ স্থানের গড় তাপমাত্রা প্রায় -৮৫° সেলসিয়াস (-১২০° ফাঃ, ১৯০ কেলভিন)।
  • মহাকাশ থেকে যেসব উল্কা পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে সেগুলি মেসোস্ফিয়ার স্তরের মধ্যে এসে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ।
  • এই স্তরের উপরে তাপমাত্রা কমে যাওয়া থেমে যায়। এই স্তরকে মেসোবিরতি (Mesopause) বলে।
  • স্ট্রাটোমন্ডল ও মেসোমন্ডলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে তাপমাত্রার স্থির অবস্থাকে স্ট্রাটোবিরতি (stratopause) বলে।

মেসোপজ (Mesopause):- মেসোস্ফিয়ারের ওপরে যে উচ্চতায় তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়া থেমে যায়- অর্থাৎ পজ করে, তাকে মেসোপজ বলে ।

আয়নোস্ফিয়ার (Ionsphere):

  • ভূপৃষ্ঠের ঊর্ধ্বে ১০০ কিমি থেকে ৩০০ কিমি পর্যন্ত উচ্চতায় বিস্তৃত হালকা বায়ূস্তরকে আয়নোস্ফিয়ার বলা হয় ।
  • বিজ্ঞানী কেনেলি ও হেভিসাইড সর্বপ্রথম আয়নোস্ফিয়ারের উপস্থিতি প্রমাণ করেন।
  • এটি আবার দুটি উপস্তরে ভাগ করা থাকে- D-স্তর (বিস্তার ৮০-৯০ কিমি) ও E-স্তর বা কেনেলি-হেভিসাইড স্তর (বিস্তার ৯০-১২০ কিমি)
  • এই স্তরের বাতাস আয়নিত অবস্থায় থাকে, অর্থাৎ এই বিরাট অঞ্চলটি বিদ্যুতযুক্ত অসংখ‍্য আয়ন ও ইলেকট্রনে পূর্ণ হয়ে থাকে। এখানে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, ওজোন প্রভৃতি গ্যাস আয়নিত অবস্থায় থাকে।
  • তড়িতাহত অণুর চৌম্বক বিক্ষেপের ফলে এখানে সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলে এক রকম উজ্জ্বল আলোক বিচ্ছুরণ দেখা যায়, একে মেরুজ্যোতি বা মেরুপ্রভা বলে।
  • ভূপৃষ্ঠের বেতার তরঙ্গগুলি আয়নোস্ফিয়ার ভেদ করে আরও ওপরে যেতে পারে না বলে এই স্তর থেকে বেতার তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। তাই বিভিন্ন রেডিও স্টেশন থেকে প্রচারিত গান, বাজনা, নাটক, কবিতা, সংবাদ প্রভৃতি আমরা রেডিওর মাহ্যমে বাড়িতে বসে শুনতে পাই।
  • বিপজ্জনক X-রশ্মির থেকে আয়নোস্ফিয়ার জীবজগতকে রক্ষা করে।

Thermosphere (তাপমন্ডল):

  • আয়নোস্ফিয়ারের নিম্নভাগকে (৮০-১২০ কিমি) থার্মোস্ফিয়ার বলা হয়।
  • এই স্তর প্রায় বায়ুশুন্য। এই স্তরে বায়ুর তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ে তাই এর নাম তাপমন্ডল।
  • এই স্তরের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ১,৫০০° সেলসিয়াস (২,৭০০° ফারেনহাইড) পর্যন্ত হয়।
  • এই স্তরের সবচেয়ে উপরের বাতাসের তাপমাত্রা স্থির থাকে। তাপমাত্রার এই স্থির অংশকে সমতাপ অঞ্চল বা Isothermal Region বলে।

এক্সোমন্ডল (Exosphere)

  • আয়নোস্ফিয়ারের উপরে প্রায় ৯৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত যে বায়ুস্তর আছে তাকে এক্সোমন্ডল বলে।
  • এই স্তরের উপাদান হিসেবে খুব সামান্য পরিমাণ গ্যাস যেমন: অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, আর্গন, হিলিয়াম থাকে। এই স্তরে হিলিয়াম ও হাইড্রোজেন গ্যাসের প্রাচুর্যতা বেশি দেখা যায়।
  • এর তাপমাত্রা ৩০০ থেকে ১৬৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

ম্যাগনেটোস্ফিয়ার [Magnetosphere]:-

এক্সোস্ফিয়ারের উপরে অবস্থিত বায়ুমণ্ডলের সর্বশেষ স্তরকে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার বলে । এই স্তরের জন্য পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের আয়নিত কণার উপস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হয় ।