ঔরঙ্গজেব ( ১৬৫৮-১৭০৭ ) :

জন্ম ও বংশ পরিচয়:-

  • ১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ নভেম্বর গুজরাটের দাহোদ-এ জন্মগ্রহণ করেন। এর পিতা ছিলেন পঞ্চম মোগল সম্রাট শাহজাহান। মায়ের নাম মুমতাজ মহল।
  • ঔরঙ্গজেবের প্রথম স্ত্রী বাই বেগম আর দ্বিতীয় স্ত্রী দিলরাস বানু বেগম ।
  • তার পাচ পুত্র(মুহাম্মদ সুলতান, বাহাদুর শাহ, আজম শাহ, মুহাম্মদ আকবর, মুহাম্মদ কাম বক্স) ও দুই কন্যার ( জেব-উন-নেসা, বদর-উন-নেসা) কথা ইতিহাসে জানা যাই।

সিংহাসন আরোহন:-

  • শাজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েণ এবং তার পুত্রদের বিভিন্ন প্রদেশের দায়িত্ব দেন । দারা ছিল দিল্লি , শাহ বাংলা , মুরাদ গুজরাট এবং ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য ।
  • ঔরঙ্গজেব দারাসিকোকে ধর্মাট , সামুগড় ও দেওয়াই এর যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন এবং আততায়ী দ্বারা নিহত করেন ।
  • ঔরঙ্গজেব ১৬৫৯ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে খাজোয়ার যুদ্ধে সুজাকে পরাস্ত করেন ও নিহত করেন ।

সাম্রাজ্য বিস্তার:-

  • ১৬৬১ খ্রি সম্রাট মীর জুমলাকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং তাকে কুচবিহার ও আসামের নৃপতিদেরকে দমন করার জন্য প্রেরণ করেন করেন । মীর জুমলা কুচবিহার দখল করেন এবং স্থানটির নাম রাখেন আলমগীর নগর ।
  • এরপের মীর জুমলা আসাম দখল করলেও তাঁর মৃত্যুর(১৬৬৩ খ্রি.) পর আহোমরা তাদের হস্থচ্যুত স্থানগুলো আবার দখল করে নেই ।
  • মীর জুমলা মৃত্যুর পর ঔরঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে দাক্ষ্র্র্রিনাত্যে থেকে প্রত্যাহার করে বাংলার শাসনর্কা নিযুক্ত করেন ।শায়েস্ত খান ৩০ বছর এই পদে অদিষ্ঠিত ছিলেন । শায়েস্তা খাঁ আরাকান রাজকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম এবং মগ ও পাের্তুগিজ জলদস্যুদের পরাজিত করে সন্দীপ দখল করেন । ঔরঙ্গজেব উত্তর – পশ্চিম সীমান্তে ‘ অগ্রসর নীতি ‘ অবলম্বন করেন ।
  • ১৬৬৭ খ্রি. ইউসুফজাই নামক এক উপজাতি ভাগু নামক এক নেতার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । ঔরঙ্গজেব উপজাতিদের বিরুদ্ধে মুঘল সেনাপতি কামিল খান ও আমীন খানকে প্রেরন করেন । অবশেষে তারা উপজাতিদের দমন করতে সমর্থ হন ।
  • ১৬৭২ খ্রি. আফ্রিদিরা আকমল খানের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে । আলী মসজিদ নামক স্থানে আফ্রিদির মুঘলদের পরাজিত করেন।পরবর্তীতে খটকেরাও আফ্রিদিদের সঙ্গে যোগ দেয় । খটকদের নেতা ছিলেন খুশহাল খান । ১৬৭৪ খ্রি. আফগান বিদ্রোহীরা মুঘল বাহিনীকে আক্রমণ করে ।মুগল সেনাপতি সুজাত খান নিহত হন ।ঔরঙ্গজেব নিজে এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন ।১৬৭৪ খ্রি. তিনি হাসান আবদালে উপস্থিত হন ।তিনি কূটনীতি ও সামরিক শক্তির দ্বারা বিদ্রোহী আফগানদেরকে দমন করতে সক্ষম হন ।কাবুলে মুঘল শাসন কর্তা আমীর খান আফগানদের দমন করেন ।পরবর্তীতে খুশহাল খান কে মুঘল বাহিনী পরাজিত করে ।
  • ঔরঙ্গজেব প্রধানত মারবাড় ও মেবার — এই দুই রাজপুত রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন । ঔরঙ্গজেব দীর্ঘ ত্রিশ বছর রাজপুতানার যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন । রাঠোর বীর দুর্গাদাস ছিলেন মারবাড়ের রাজা যশােবন্ত সিংহের অনুচর ।
  • ১৬৯০ খ্রিঃ মধ্যে ঔরঙ্গজেবের সাম্রাজ্য পশ্চিমে কাবুল থেকে পূর্বে চট্টগ্রাম ও উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে কাবেরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ।
  • ঔরঙ্গজেব শিখদের নবম গুরু তেগবাহাদুরকে হত্যা করেছিলেন ( ১৬৭৫ খ্রিঃ ) । তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি হল ‘ শিরদিয়া সার না দিয়া ‘ ।

ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি

যৌধপুরের রাজা যশোবন্ত সিংহ ১৬৭৮ খ্রি. সীমান্তে জামরুদে মৃত্যুমুখে পতিত হন । তার কোনো পুত্র সন্তান ছিল না । সম্রাট মৃত রাজার ভ্রাতুষ্পুত্র ইন্দ্রসিংকে যোধপুরের গদিতে বসান। এদিকে যশোবন্তের পরিবার লাহোরে পৌছলে,তার দু মহিষী দু পুত্র সন্তান প্রসব করে । একজন মারা যায় এবং একজন জীবিত থাকে । জীবিত সন্তানের নাম রাখা হয় অজিত সিংহ। অজিত সিংহ ও তার মাতাকে নিয়ে দুর্গাদাস নামে একজন রাজপুত দিল্লিতে পৌছেন এবং অজিত সিংহকে যোধপুরে সিংহাসনের উত্তরাধীকারি হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য সম্রাটের নিকট অনুরোধ করেন ।সম্রাট অজিত সিংহকে মুঘল হারেমে প্রতিপালনের প্রস্তাব দেন । আর অজিত রয়ঃপ্রাপ্ত হলে তাকে যোধপুরের গদিতে বসান হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন । বালক অজিতকে মুসলমান করা হবে বলে এই ভয়ে রাজপুত দুর্গাদাস যৌধপুরে পালয়ন করেন এবং ইন্দ্র সিংহকে অপসারিত করে অজিতকে সিংহাসনে বসান । দুর্গাদাস প্রতিবেশ মেবার রাজের সাহায্য কামনা করেন । মেবার রাজ তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন । সম্রাট দুর্গাদাসের এরুপ কাজের জন্য অসুন্তুষ্ট হন । তারপর সম্রাট তার পুত্র যুবরাজ আকবরকে সৈন্য সহ যোধপুরের বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দেন ।যুদ্ধে যোধপুরের বহু শহর মুঘলদের দখলে আসে । এদিকে দুর্গাদাস মুঘল সৈন্যের চাপ সহ্য করতে না পেরে কূটকৌশলে গ্রহণ করে যুবরাজ আকবরকে পিতার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন ।যুবরাজ আকবর আগে থেকে পিতার প্রতি অসুন্তষ্ঠ ছিরেল ।আকবর বিদ্রোহ করেন এবং প্রায় ৭০০০০ সৈন্য নিয়ে আজমীরের দিকে অগ্রসর হন । এতে ঔরঙ্গজেব উদ্বিগ্ন হন । কারন তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সৈন্য ছিল না । তিনি কৌশলে আকবর ও রাজপুতদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্ঠি করেন।আকবর বাধ্য হয়ে দাক্ষিণাত্যের মারাঠা নেতা শম্ভজির দরবারে পালয়ন করেন । এবার ঔরঙ্গজেব রাজপুতদেরকে আক্রমণ করেন । উদয়পুরের রাজা ঔরঙ্গজেব নিকট সন্ধির প্রস্তাব করেন । তিনি সন্ধির জন্য প্রস্তুত ছিলেন । কারন আকবর তখন দক্ষিণে গমন করেন । তিনি উত্তর ভারতে সমস্যা আপাতত মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী হন । রানা তিনটি ক্ষুদ্র এলাকা সম্রাটকে ছেড়ে দেন । কিন্তু যোধপুরের রাজপুতরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে । যুদ্ধে কোন ভবিষৎ নেই দেখে অজিত সিংহ সম্রাটের নিকট ক্ষমা চাই। ১৬৯৮ খ্রি.সম্রাট ক্ষমা করেন এবং তাকে যমোবন্তের উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকার করেন। দুর্গাদাসকেও ঔরঙ্গজেব ক্ষমা করেন ।

ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতিবিজাপুর ও গােলকুণ্ডার শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত শাসকদ্বয় এবং মহারাষ্ট্রের হিন্দু-মারাঠা সর্দার শিবাজীকে দমন করে নিজ লক্ষ্য পূরণ করতে শাসনকালের প্রায় অর্ধেক সময় ( ১৬৮২-১৭০৭ খ্রিঃ ) তিনি দাক্ষিণাত্যে অতিবাহিত করেছিলেন ।

  • বিজাপুর আক্রমণ :গোলকুণ্ডার ব্রাহ্মণ-মন্ত্রী মদন্ন ও অকন্ন-র নেতৃত্বে বিজাপুর , গােলকুণ্ডা ও মারাঠাজাতি মুঘল বিরােধী জোট গঠন করে । বাহাদুর খাঁ ও দিলীর খাঁ পরপর সুবাদার নিযুক্ত হয়েও এই জোট ভাঙতে ব্যর্থ হন । এরপর ঔরঙ্গজেব নিজ পুত্র আজমকে বিজাপুর আক্রমণের নির্দেশ দেন ( ১৬৮০ খ্রিঃ ) । ১৬৮৫ খ্রিঃ বিদ্রোহী পুত্র মহম্মদ আকবরকে অনুসরণ করে স্বয়ং ঔরঙ্গজেবও দাক্ষিণাত্যে উপস্থিত হন । ইতিমধ্যে আজম বিজাপুরের বিভিন্ন অঞ্চল বিধ্বস্ত করে বিজাপুর অবরােধ করেন । সম্রাটের বাহিনী যােগদান করলে বিজাপুরের প্রতিরােধ ভেঙে পড়ে । বিজাপুরের সম্রাট আদিল শাহ আত্মসমর্পণ করেন । তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং বিজাপুরকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ( ১৬৮৬ খ্রিঃ ) ।
  • গোলকুণ্ডা আক্রমণ :আসলে বিজাপুরের পতনের ফলে গােলকুণ্ডার পতনও অনিবার্য হয়ে পড়ে । ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে গোলকুণ্ডার কুতুব শাহি বংশের বিরুদ্ধে ঔরঙ্গজেব মুঘলবাহিনী প্রেরণ করেন । এক বছরের মধ্যেই গোলকুণ্ডার পতন ঘটে । গোলকুণ্ডার সুলতান আবুল হাসান মুঘলবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন । আবুল হাসান বন্দি হন এবং গোলকুণ্ডা মুঘল সাম্রাজ‍্য ভুক্ত হয় ।
  • ঔরঙ্গজেব-মারাঠা সংঘাত:শিবাজী জাতীয়তাবােধ ও ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে বিচ্ছিন্ন মারাঠা জাতিকে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন । শিবাজীর হিন্দু রাষ্ট্রের আদর্শ ঔরঙ্গজেবের ক্রোধকে ভীষণভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল । তিনি তার মাতুল শায়েস্তা খানকে দাক্ষিণত্যের সুবাদার নিযুক্ত করে শিবাজীর মক্তিকে দমন করার নির্দেশ দেন ।শায়েস্তা খান মিবাজীর কয়েকটি দুর্গ দখল করে সেখানে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৬৬৩ খ্রি. এক রাতে শিবাজী শাযেস্তা খানের শিবির আক্রমন করে তার পুত্রকে হত্যা করেন আর শায়েস্তা খান হাতের একাট আঙ্গুল হারিয়ে কোন রকম পালিয়ে যেতে সমর্থন হয় । ১৬৬৪ খ্রি. শিবাজী সুরাট দুর্গ লুন্ঠন করেন ঠিক এই সময় ঔরঙ্গজেব শিবাজী বিরুদ্ধে যুবরাজ মুয়াজ্জম ও রাজা জয়সিংহকে প্রেরণ করেন ।মুঘল বাহিনী শিবাজীর পুরন্দর দূর্গ অবরোধ করে শেষে শিবাজী কোন উপায় না পেয়ে মুঘলদের সঙ্গে পুরন্দরের সদ্ধির প্রস্তাব করেন এবং ১৬৬৫ খ্রি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় ।অতঃপর জয়সিংহের অনুরোধে শিবাজী মুঘল দরবারে আগমন করেন আর সম্রাট শিবাজীকে বন্দী করে কিন্তু কিছু দিন পর কৌশলে তিনি পলায়ন করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হন । ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় শিবাজীর সাথে মুঘলের সংঘর্ষ শুরু হয় । শিবাজী পুরন্দরের সন্ধি দ্বারা ( ১৬৬৫ খ্রিঃ ) মুঘলদের যেসব স্থান ও দুর্গ ছেড়ে দিয়েছিলেন , সেগুলি দখল করতে শুরু করেন । তিনি একে একে পুরন্দর , মাদুরা ও কোঙ্কন অধিকার করেন এবং কোঙ্কন থেকে মুঘল সুবাদারকে বহিস্কৃত করেন । ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে ‘ ছত্রপতি ’ উপাধি নেন । শিবাজীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শম্ভুজীর সাথে ঔরঙ্গজেবের যুদ্ধ হয় । তবে তিনি ঔরঙ্গজেবের হাতে বন্দি ও নিহত হন । শম্ভুজীর মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা রাজারামের নেতৃত্বে মারাঠা-মুঘল সংঘর্ষ চলতে থাকে । রাজারামের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী তারাবাঈ মুঘল বিরােধী অভিযান চালিয়ে যেতে থাকেন । এমন অবস্থায় ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয় ( ১৭০৭ খ্রিঃ ) ।

শাসন ব্যাবস্থা :-

  • বিখ্যাত রাজপুত সেনাপতি রামসিংহ ঔরঙ্গজেবের অধীনে উচ্চপদে বহাল ছিলেন ।
  • সিংহাসন দখলের যুদ্ধে মারওয়াড়রাজ যশােবন্ত সিংহ দারা শিকোহর পক্ষ নিলেও ঔরঙ্গজেব তাকে ক্ষমা করেন এবং মনসবদার পদে নিযুক্ত করেন ।
  • ঔরঙ্গজেবের রাজনৈতিক ব্যাপারে উলেমা নির্ভরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন যে দুজন মুসলিম অভিজাত তারা হলেন — মহাবৎ খাঁ , মীর্জা লারা ।
  • অম্বরের রানা জয়সিংহও একজন বড়ো মনসবদার ছিলেন । মারাঠা বীর শিবাজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুঘলদের সাফল্য এনে দেন জয়সিংহ । কিন্তু শিবাজীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার ঔরঙ্গজেবকে সন্ধিহান ও রুষ্ট করে । তিনি গােপনে বিষ প্রয়ােগ করে জয়সিংহকে হত্যা করেন ।

ধর্মনীতি:-

  • তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস তার রাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে ভারতবর্ষকে ‘ দার উল ইসলাম ’-এ পরিণত করাকে তিনি নিজের নৈতিক ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করতেন ।
  • আকবরের আমলে যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগঠনের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল , তা সম্পূর্ণভাবে বর্জিত হয় । ঔরঙ্গজেব ইসলামের অনুশাসনগুলি কঠোরভাবে মান্য করার নির্দেশ দেন । এজন্য তিনি মুঘল দরবারে প্রচলিত বহু অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি বন্ধ করার আদেশ জারি করেন ।
  • তিনি আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত দীন-ই-ইলাহী রহিত করেন ।
  • তার নির্দেশে ‘ নওরােজ ’ অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয় ।
  • সম্রাটের জন্মদিনে তার দেহের ওজনের সমপরিমাণ সােনা-রূপা দান করার প্রথা ( তুলা দান ) বন্ধ করা হয় ।
  • রাজদরবারে নৃত্যগীতি নিষিদ্ধ হয় । অধিকাংশ গায়ক ও বাদককে দিল্লি ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয় ।
  • তিনি সম্রাজ্যে মদপান ও জুয়াখেলা নিসিদ্ধ করেন ।
  • ঔরঙ্গজেব ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুদের উপর ‘ জিজিয়া কর ’ পুনঃপ্রবর্তন করেন ।
  • সম্রাট কপালে চন্দনের রাজটিকা দেওয়ার প্রথাও তিনি নিষিদ্ধ করা হয় ।
  • তিনি মহররমের মিছিল বন্ধ করেন । হিন্দুদের সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেন ।
  • ঔরঙ্গজেব খাটি ইসলামীয় আচরণ বিধি সর্বসাধারণের কাছে প্রচারের জন্য রচনা করেন ফতােয়া – ই – আলমগিরি ।
  • অবসর সময়ে কোরান নকল করতেন এবং টুপি সেলাই করতেন । কোরান ও টুপির বিক্রীত অর্থে তিনি নিজের সমাধিমন্দির নির্মাণের ব্যবস্থা করেন । এই কারণে সুন্নি মুসলমানগণ তাকে ‘ জিন্দাপীর ’ ( Living Saint ) বলে মনে করতেন ।

ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতির প্রতিক্রিয়া

  • জাঠ বিদ্রোহ :মথুরার মুঘল ফৌজদার আব্দুল নবি মথুরা নগরে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর মসজিদ নির্মাণ করেন । কেশব রায়ের মন্দিরে দারা শিকোহ প্রদত্ত প্রস্তরনির্মিত রেলিংটিও অপসারিত করেন । এতে ক্ষুব্ধ জাঠগণ তিলপতের জমিদার গােকলার নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয় ( ১৬৬০ খ্রিঃ ) । মুঘলবাহিনী কঠোর হস্তে এই বিদ্রোহ দমন করে এবং গােকলাকে হত্যা করা হয় । ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে রাজারামের নেতৃত্বে তারা আবার বিদ্রোহ ঘােষণা করে । রাজারামের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র চূড়ামনের নেতৃত্বে জাঠরা তৃতীয়বার বিদ্রোহী হয় ( ১৬৯১ খ্রিঃ ) । ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ দিন পর্যন্ত জাঠদের আন্দোলন চলতে থাকে । শেষ পর্যন্ত জাঠরা স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে ।
  • সাৎনামী বিদ্রোহপাঞ্চাবের বর্তমান পাতিয়ালা এবং মেওয়াট অঞ্চলে সাৎনামী নামে এক হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস ছিল । একজন মুঘল সৈন্য কর্তৃক জনৈক সৎনামী কৃষক নিহত হলে ১৬৭২ খ্রি.তার তারা মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । সৎনামীদের বিদ্রোহ দমন করতে মুঘল বাহিনীকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুঘল বাহিনী তাদের পরাজিত করে ঐ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
  • বুন্দেলা বিদ্রোহবুন্দেলাখন্ডের বুন্দেলা রাজপুতেরগণ প্রথমে চম্পত রায়ের নেতৃত্বে মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । কিন্তু পরে মুঘলদের হাতে বন্দী হওয়ার ভয়ে আত্মহত্যা করেন। তার পুত্র ছত্রসাল কিছুকাল ঔরঙ্গজেবের অধীনে কাজ করেন। পরে নির্যাতিত বুন্দেলাদের মুক্তির জন্য মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন ( ১৬৭১ খ্রিঃ ) । তার নেতৃত্বে বুন্দেলখণ্ডে স্বাধীন হিন্দুরাজ্য স্থাপিত হয় ।
  • শিখ বিদ্রোহঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির ফলে শিখসম্প্রদায়ও বিদ্রোহ ঘােষণা করে । নবম শিখগুরু তেগবাহাদুর ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির প্রতিবাদ করেন । ক্ষুব্ধ ঔরঙ্গজেব তেগবাহাদুরকে হত্যা করলে শিখগণ ঔরঙ্গজেবের উপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয় । পরবর্তী শিখগুরু গােবিন্দ সিংহ পিতৃহত্যার প্রতিশােধ গ্রহণে শিখদের তিনি সামরিকবিদ্যায় পারদর্শী হতে নির্দেশ দেন । তিনি ‘ খালসা পন্থ ’ নামে শিখ সামরিক বাহিনী গড়ে তােলেন । তিনি কেশগড় , লােহাগড় , ফতেগড় ও আনন্দগড়ে কয়েকটি দুর্গ গড়ে তােলেন । ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি মুঘলদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকেন । শেষ পর্যন্ত ঔরঙ্গজেব তাকে দরবারে আমন্ত্রণ করেন । কথিত আছে , পথিমধ্যে এক আততায়ী তাকে হত্যা করেন ।

শেষ জীবন :-ঔরঙ্গজেব ১৭০৭ খ্রি. ৩ মার্চ ৯০ বছর বয়েসে দাক্ষিণাত্যের আহমদনগরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।তার মৃতদেহ দৌলতাবাদে আনা হয় এবং সেখানে বিখ্যাত মুসলিম সাধক বুরহান উদ্দীননের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করা হয়।