বাবর ( ১৫২৬-১৫৩০ খ্রিঃ ) :

জন্ম ও বংশ পরিচয়:-

  • ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারি মধ্যএশিয়ার (রুশ-তুরস্কের মধ্যবর্তী স্থানে) ফরগনা প্রদেশে বাবর জন্মগ্রহণ করেন।
  • পিতা ওমর শেখ মির্জার দিক থেকে তিনি ছিলেন তৈমুর লঙের বংশধর এবং মাতা কুতলুগ নিগার খানুমের দিক থেকে তিনি ছিলেন চেঙ্গিস খাঁর বংশধর।
  • বাবরের পুরোনাম জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর। মঙ্গোলীয় ভাষায় বাবর কথার অর্থ ‘বাঘ‘।
  • বাবরে বৈধ স্ত্রীর সংখ্যা ছিল সাত জন, মোট পুত্রের সংখ্যা ছিল চার জন-হুমায়ুন,আশাকরি,কামরান এবং হিন্দাল।
  • গুলবদন বেগম ছিল বাবরের একমাত্র কন্যা সন্তান।

সিংহাসন আরোহন:-

  • তিনি মাত্র ১২ বছর বয়সে (১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে) সিংহাসনে বসেন ও ফরগনা ( আফগানিস্থান ) রাজের শাসন কর্তা হন।
  • তিনি দু'বছর পরে সমরকান্দ জয় করেছিলেন কিন্তু ফরগনার কর্তৃত্ব হারাতে হয়েছিল। পরবর্তীকালে ফরগানা পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হলেও সমরকান্দের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।
  • কিন্তু 1501 খ্রিস্টাব্দে ফরগনাতে বাবরের প্রধান প্রতিবন্ধক সাহাবানি খান (উজবেক শাসক) বাবরকে পরাস্ত করে তার বোন খান্দাজা বেগমকে বিয়ে করেন।
  • বাবর সিংহাসন হারিয়ে আশ্রয়ের জন্য মামা মাহমুদ খানের কাছে তাসখন্দে যান।
  • তার এই পরাজয়ের গ্লানি দূর করে পুনরায় 1503 খ্রিস্টাব্দে ফরগনা দখলের চেষ্টা করলে ‘অর্চিয়ানের’ যুদ্ধে বাবর আবারও ব্যর্থতায় পর্যভূষিত হন।
  • 1504 খ্রিস্টাব্দে আবারও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং উলূঘ বেগের শিশুপুত্র আব্দুর রজ্জাকের কাছ থেকে কাবুল অধিকার করে “আফগানিস্তানের বাদশাহ”-উপাধি নেন।
  • 1507 খ্রিস্টাব্দে গজনী দখল করে নিজেকে “বাদশাহ” উপাধিতে ভূষিত করেন।
  • 1511 খ্রিস্টাব্দে পারস্যের সম্রাট ইসমাইল শাহের সঙ্গে মিত্রতায় সমরখন্দ ও মধ্যএশিয়া জয় করেন।
  • 1512 খ্রিস্টাব্দে উজবেকী সর্দার উবাইদ উল্লাহ খান “গাজদাওয়ানের”-যুদ্ধে ইসমাইল শাহ ও বাবরের যৌথ বাহিনীকে পরাস্ত করেন।
  • তিনি উজবেকদের কাছ থেকে তুলুঘ্মা ও আবা যুদ্ধ পদ্ধতি আয়ত্ত্ব করেন।

ভারত অভিযান:-

  • 1519 খ্রিস্টাব্দে জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর খাইবারপাশ দিয়ে প্রথম ভারত অভিযান করে খুব সহজেই ভেরা ও বাজাউর জয় করেন এবং কিছুদিন পরেই কাবুলে ফিরে যান।
  • 1519 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় বার ভারত আক্রমণ করে পেশোয়া দখল করেন। কিন্তু বাদখশানে বিদ্রোহ শুরু হলে বাবর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
  • 1520 খ্রিস্টাব্দে বাবর তৃতীয়বার ভারত আক্রমণ করেন। বাজাউর,ভেড়া এবং শিয়ালকোট খুব সহজে দখল করেন কিন্তু কান্দাহারে বিদ্রোহ শুরু হলে তিনি দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
  • 1524 খ্রিস্টাব্দে বাবর আবারও ভারত আক্রমণ করেন। এই সময় লাহোরের শাসনকর্তা দৌলত খাঁ লোদী ও তার পুত্র দিলওয়ার খান এবং গুজরাটের শাসনকর্তা আলম খাঁ দিল্লীর সুলতান ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে বাবরের সাহায্য চেয়ে পাঠান। বাবর সাহায্যের উদ্দেশ্যে ভারত আক্রমণ করেন এবং দৌলত খাঁর সাথে বাবরের মতবিরোধ দেখা দিলে বাবর লাহোর ও দীপালপুর অধিকার করে কাবুলে ফিরে যান। দৌলত খাঁ লোদী লাহোর পুনরুদ্ধার করেন।
  • 1525 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে পঞ্চম তথা শেষ ভারত আক্রমণ করেন।দৌলত খাঁ লোদী শেষ পর্যন্ত বাবরের সাথে থাকলেও গুজরাটের শাসনকর্তা আলম খাঁ গুজরাটে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এই আলম খাঁ লোদীই ছিলেন দিল্লীর সিংহাসনের প্রধান দাবিদার। 1526 খ্রিস্টাব্দের 26 শে ফেব্রুয়ারি বাবরের জেষ্ঠ্য পুত্র হুমায়ুন হামিদ খানকে পরাস্ত করে হিসার-ফিরোজা শহর লুঠ করেন। বাবর হুমায়ুনের এই সাফল্যে খুশি হয়ে হিসার-ফিরোজার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেন।

মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন:-

  • 1526 খ্রিস্টাব্দের 21 শে এপ্রিল ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথ গ্রামে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবর ইব্রাহিম লোদীকে পরাস্ত করে ভারতের মাটিতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। ইব্রাহিম লোদীর লক্ষাধিক সেনাবাহিনী থাকলেও মাত্র বারো হাজার সেনা নিয়ে ‘রুমি ’ ও ‘তুঘলমা ’ নামক পদ্ধতি ব্যবহার করে যুদ্ধে জয়লাভ করে । এই যুদ্ধে প্রথম ভারতে কামান ব্যবহৃত হয়।

মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার:-

  • মেবারের রানা সঙ্গ প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবরকে সাহায্য করলেও 1527 খ্রিস্টাব্দের 17 ই মার্চ খানুয়ারের যুদ্ধে বাবর রানা সঙ্গকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করেন। এই যুদ্ধে জয়ের পরই বাবর “গাজী”-উপাধি নেন।
  • বাবর 1528 খ্রিস্টাব্দের 21 শে জানুয়ারি “চান্দেরীর”-যুদ্ধে রাজপুত রাজা মেদিনী রাইকে হারিয়ে চান্দেরী দুর্গ দখল করে নেন। বাবর তাঁর দুই পুত্র হুমায়ুন ও কামরানকে মেদিনী রাই এর দুই মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে ভারতে রাজপুত বিবাহ নীতির বীজ বপন করেন।
  • 1528 খ্রিস্টাব্দের 2 রা ফেব্রুয়ারি বাবরের সেনাপতি অযোধ্যা ও লখনৌ জয় করেন।
  • 1529 খ্রিস্টাব্দের 6 ই মে রাজস্থানের ঘাগরা নদীর তীরে ঘর্ঘরার বা ঘাঘরার যুদ্ধে আফগান রাজা মামুদ লোদীকে ( ইব্রাহিম লোদীর ভাই ) পরাজিত করেন।

সাহিত্যচর্চা:-

  • বাবর তুর্কী ভাষায় “তুজুক-ই-বাবরী” বা “বাবরনামা” নামে এক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ লেখেন।
  • তিনি ফার্সী ভাষায় “মুবাইয়ান“-নামে কাব্যগ্রন্থ লেখেন।
  • বাবরের ব্যক্তিগত চরিত্রকে নিয়ে তাঁর খুড়তুতো ভাই মির্জা হায়দার লেখেন “তারিখ-ই-রশিদি“-নামে একটি গ্রন্থ।
  • বাবরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলো “খাত-ই-বাবরী” নামে একটি তুর্কী হরফের প্রচলন।

স্থাপত্য:-

  • পানিপথের প্রথম যুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে তিনি পানিপথে “কাবুলিবাগ মসজিদ“-নির্মাণ করেন।
  • নির্মাণ করেন সম্বলপুরে(রোহিলাখণ্ডে) জাম্মা বা জমি মসজিদ এবং আগ্রাতে নির্মাণ করেন লোদী দূর্গ।

শেষ জীবন :-

  • 1530 খ্রিস্টাব্দের 26 শে ডিসেম্বর বাবর 48 বছর বয়সে আগ্রায় মারা যান।
  • প্রথমে সমাহিত করা হয় আগ্রার আরামবাগে। পরে তাঁর এই সমাধি মন্দির স্থান্তরিত করা হয় আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে।
  • কাবুলে তাঁর সমাধিস্থলের নাম “গার্ডেন্স অফ বাবর”বা “বাঘ-ই-বাবর“।