শাজাহান ( ১৬২৮-১৬৫৮ খ্রিঃ ) :

জন্ম ও বংশ পরিচয়:-

  • ১৫৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি, তিনি লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন চতুর্থ মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং তার মা ছিলেন রাজপুত রমণী মনমতি।
  • পূর্ব নাম ছিল শাহাজাদা খুররাম।
  • শাহজাহান নামটি এসেছে ফার্সি ভাষা থেকে যার অর্থ "পৃথিবীর রাজা"।
  • তার চারপুত্র দারা , সুজা , ঔরঙ্গজেব ও মুরাদ ।
  • তার তিন কন্যা জাহান আরা, রোশন আরা, গহর আরা।
  • ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি নূরজাহানের ভ্রাতা আসফ খানের কন্যা মুমতাজ মহল(আঞ্জুমান বিবি) কে বিবাহ করান।

সিংহাসন আরোহন:-

  • তিনি ১৬২৭ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
  • সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে ১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আট হাজারি মনসবদারি পদ লাভ করেন।
  • ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দশ হাজারি মনসবদারি পদ লাভ করেন।
  • ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে মেবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় শাহাজাহানকে সেনাপ্রধান করে পাঠানো হয়। এই যুদ্ধে শাহজাহান মেবারের রাজা অমর সিংহের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। এই যুদ্ধ জয়ের পর, সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁকে 'শাহজাহান' উপাধি দেন।
  • মোগলবাহিনীর অরাজকতার সুযোগে মালিক অম্বর বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফলে মালিক অম্বরের বিরুদ্ধে শাহাজাহানকে আবার যুদ্ধে পাঠানো হয়। এবারও মালিক অম্বর পরাজিত হন। এবারের যুদ্ধে মোগল বাহিনী বিজাপুর, আহম্মদনগর ও গোলকুণ্ডা অধিকার করেন। এই সময় মালিক অম্বর বিপুল অঙ্কের টাকা নজরানা দিয়ে মোগলদের সাথে সন্ধি করেন।
  • ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহানের বিদ্রোহের সূত্রে মোগল বাহিনীর সাথে একটি যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শাহজাহান পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে যান। এই সময় যুবরাজ পারভেজ ও সেনাপতি মহবৎ খাঁকে শাহজাহানের বিরুদ্ধে পাঠালে, শাহজাহান উড়িষ্যা, বিহার ও বঙ্গদেশ দখল করে নেন। কিন্তু এলাহাবাদের কাছে এক যুদ্ধে যুবরাজ পারভেজ ও সেনাপতি মহবৎ খাঁর সাথে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যের দিকে যান। এই সময় তিনি মালিক অম্বরের সাথে যোগ দেন। ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে মোগল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে শাহাজাহান পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন। জাহাঙ্গীর বিদ্রোহী শাহজাহানকে ক্ষমা করে দেন।
  • ১৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে যুবরাজ পারভেজ মৃত্যুবরণ করেন। কাশ্মীর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে ১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীর মৃত্যবরণ করেন। ফলে সিংহাসনের দাবিদার হন শাহজাহান এবং শাহরিয়ার।
  • জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সময়, শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে ছিলেন এবং জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর নুরজাহান লাহোরে বসবাস করতেন।। তাই আসফ খাঁ (শাহাজাহানের শ্বশুর) জাহাঙ্গীরের প্রথম পুত্র খসরু (আগেই নিহত হয়েছিলেন)-র প্রথম পুত্র দাওয়ার বক্সকে অস্থায়ী সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন। এই সময় নূরজাহান লাহোরে শাহরিয়ারকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন। আসফ খাঁ দ্রুত লাহোর আক্রমণ করে শাহরিয়ারকে বন্দী করেন এবং চোখ উপরে ফেলেন। নুরজাহানকে ক্ষমা করে দেন এবং তাঁর জন্য বাৎসরিক দুই লক্ষ টাকার বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেন।
  • তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লিতে স্থান্তর করেন ।
  • তার পুত্র ঔরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের সুবেদার নিযুক্ত করেন ।

সাম্রাজ্য বিস্তার:-

  • ১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে শাহাজাহান আগ্রায় আসেন। তিনি সিংহাসনের সকল প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা করেন। এই সময় দাওয়ার বক্স পারশ্যে পালিয়ে যান।
  • তার রাজত্বের প্রথম দিকে বুন্দেল খন্ডের রাজা ঝুঝর সিং বিদ্রোহ ঘােষণা করেন এবং দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা খান জাহান লােদী বিদ্রোহ করেন । তিনি এই বিদ্রোহ দমন করেন।
  • শাজাহান তার সাম্রাজ্য বিস্তারে সফলতা পেয়েছিল । আহমেদনগর এবং বিজয়পুর তার সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে । ১৬৩৬ খ্রিঃ গােলকুন্ডা মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে ।
  • তিনি উত্তর –পূর্বে রানা প্রতাপ সিংহের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে শ্রীহট্ট জেলা পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন ।
  • শাহজাহান মেবারের বিদ্রোহী রাজা রানা অমর সিং কে পরাজিত করেন ও মুঘলদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন।
  • সম্রাট আকবর এবং জাহাঙ্গীরের বদান্যতায় হুগলীর সাতগাঁও অঞ্চলে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি পেয়েছিল পর্তুগিজরা। পরে এরা নানাস্থানে কুঠি নির্মাণ করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। এই সময় তারা ক্রীতদাস ব্যবসা, জলদস্যুতা, স্থানীয়দের ধর্মান্তরিত করার মতো কাজ শুরু করে। এরই মধ্যে পর্তুগিজরা সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের দুইজন ক্রীতদাসীকে আটক করেল, শাহাজাহান পর্তুগিজদের দমনের জন্য কাসিম খাঁকে প্রেরণ করেন। প্রায় তিন মাস যুদ্ধের পর, পর্তুগিজ বাহিনী সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজদের ক্ষমাভিক্ষার কারণে, হুগলিতে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়।

শাসন ব্যাবস্থা :-

  • শাহজাহান প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলেন আসফ খানকে।
  • মহাব্বত খান আজমিরের রাজ্যপাল নিযুক্ত হন ।
  • শাহজাহান মহাব্বত খানকে খান-ই-খানা উপাধি প্রদান করেন।

স্থাপত্য :-

  • তার রাজত্বের সময়কালের মুঘল স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ ছিল।
  • তাকে " প্রিন্স অফ আর্কিটেকচার " বলা হয়।
  • তাজমহল, দিল্লির লাল কেল্লা, জামা মসজিদ, দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, আগ্রার মতি মসজিদ, জামা মসজিদ, খাস মহল, শিস মহল ইত্যাদি স্থাপন করেন।
  • তার আমলে দিল্লি নগরীর নামকরণ করেন 'শাজাহানবাদ' , আগ্রার নামকরণ করা হয় 'আকবরাবাদ' ।
  • মুঘল সম্রাট শাজাহান শাজানাবাদের অভ্যন্তরে সুপ্রসিদ্ধ দুর্গ তৈরি করেন । যমুনা নদীর পূর্বে চারটি বড়াে দরজা , দুটি দরজা ও ২ টি বুরুদ সহ নির্মিত হয় এই দূর্গ । যার নাম ছিল ‘ কিলা – ই – মুবারক ’ যা লালকেল্লা নামে পরিচিত । ১৮৫৭ খ্রিঃ পর্যন্ত এটাই ছিল মুঘলদের এবং পরবর্তী রাজাদের রাজধানী ।
  • তাজমহল :১৬৩১ খ্রিঃ তার প্রিয় পত্নী মুমতাজ তার চতুর্থ পুত্রের জন্মের সময় মারা যান । তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই সৌধ নির্মাণ করেন । ২২ হাজার মিস্ত্রি প্রতিদিন কাজ করে ২২ বছর ( ১৬৩১-১৬৫৩ ) ধরে এই সৌধ নির্মাণ করছিল । যার মূল কারিগরি বা নকশা তৈরি প্রধান দায়িত্ব ছিল ঈশা খাঁর হাতে । সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি দেয়ালে কোরানের বাণী লিখেছিল আমানত খাঁ মিরজা । মীর আব্দুল করিম এবং মুকরিমল খাঁ তাজমহলের আর্থিক দিক দেখভাল করেছিল । এটি ছিল মুঘল আমলের সর্বশ্রেষ্ঠ । স্থাপত্য নিদর্শন । রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বলেছিল -‘ Teardrop on the cheek of eternity ‘।
  • তিনি ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণ দ্বারা ময়ূর সিংহাসন নির্মাণ করেন।

বিদেশী পর্যটক :-

  • তার আমলে ফরাসী পর্যটক বানিয়ের ও ট্র্যাভার্নিয়ার ভারতে আসেন।
  • ইতালীয় পর্যটক নিকোলো মানুচি তার দরবারে আসেন।

শেষ জীবন :-

  • ১৬৫৮ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে পুত্র আওরঙ্গজেব তাকে বন্দী করেন এবং বন্দী অবস্থায় ১৬৬৬ সালে আগ্রা ফোর্ট -এ তার মৃত্যু হয়।