সাতবাহন রাজবংশ

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে মৌর্য সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তুপের উপর যে সকল আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটেছিল সাতবাহন ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। খ্রিষ্টপূর্ব ২৭ অব্দে কান্ব রাজবংশ -এর শেষ রাজা সুদর্শনকে পরাজিত করে রাজা সিমুক সাতবাহন রাজবংশের সূচনা করেন। সাতবাহনদের রাজধানী ছিল পৈঠান ও অমরাবতী।

ঐতিহাসিক উপাদান

  • সাতবাহন রাজবংশ সম্বন্ধে জানার উল্লেখযোগ্য উপাদান হল পুরাণ বিশেষ করে মৎস্য ও বায়ুপুরাণ, টলেমির ভূগােল এবং গুণাঢ্য রচিত বৃহৎকথা।
  • গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর মাতা গৌতমী বলশ্রী রচিত নাসিক প্রশস্তি, কলিঙ্গ রাজ খারবেলের হস্তিগুম্ফা শিলালিপি, শক রাজা রুদ্রদামনের জুনাগড় লিপি এবং রাজমাতা নায়নিকার নানাঘাট লিপিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
  • এ ছাড়াও কানহেরি, কার্লে, অমরাবতী প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত শিলালিপিগুলি থেকে এই যুগের নানা তথ্যাদি পাওয়া যায়।

সিমুক:

  • খ্রিষ্টপূর্ব ২৭ অব্দে রাজা সিমুক কান্ব রাজবংশ -এর শেষ রাজা সুদর্শনকে পরাজিত করে সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
  • তিনি বিদিশা জয় করেছিলেন।
  • তিনি বৌদ্ধ ও জৈনদের জন্য মন্দির তৈরি করেন।
  • তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে, তিনি বেশ অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলেন। ফলে তিনি সিংহাসন চ্যুত হন এবং পরে তাঁকে হত্যা করা হয়।

কৃষ্ণ:

  • সিমুকের পরে রাজত্ব গ্রহণ করেন তাঁর ভাই কৃষ্ণ।
  • তার আমলে সাতবাহন রাজ্যের সীমানা পশ্চিমে নাসিক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
  • তার রাজত্বকালে নাসিকে বৌদ্ধ শ্ৰমণদের বসবাসের জন্য একটি গুহা নির্মিত হয়।

প্রথম সাতকর্ণী:

  • কৃষ্ণের পরে রাজত্ব লাভ করেন কৃষ্ণের পুত্র সাতকর্ণী।
  • সাতকর্ণী পশ্চিম মালব রাজ্য, নর্মদা উপত্যকা ও বিদর্ভ জয় করেন। পশ্চিম মালব জয়ের পর তিনি দুটি অশ্বমেধ ও একটি রাজসূয় যজ্ঞ করেন।
  • হাতীগুম্ফা শিলালিপি থেকে জানা যায়, সাতকর্ণী কলিঙ্গরাজ খারবেলকে পরাজিত করেছিলেন।
  • তিনি প্রতিষ্ঠানপুর বা বর্তমান পৈঠানে তার রাজধানী স্থাপন করেন।
  • তিনি দক্ষিণাপথপতি, বিন্ধ্য অধিপতি ও অপ্রতিহতচক্র উপাধি ধারণ করেন।

পরবর্তী শাসকগণঃ

প্রথম সাতকর্ণীর মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র শক্তিশ্রী নাবলক ছিলেন। এই কারণে সাতকর্ণীর মহিষী নায়নিকা বেদশ্রী, তাঁর পুত্রের অভিভাবিকারূপে কিছুদিন রাজত্ব করেন। এই সময় সাতবাহন রাজ্য শক, পহ্লব এবং কুষাণদের আক্রমণের শিকার হয়। ফলে সাতবাহন রাজ্য ক্রমান্বয়ে দুর্বল ও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। প্রথম সাতকর্ণীর পরবর্তী শাসকগণ যাদের কৃতিত্ব সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না তারা হলেন- ১) সিমুকা, ২) কৃষ্ণ, ৩) প্রথম সাতকর্ণী, ৪) পূর্ণোৎসঙ্গ, ৫) স্কন্দস্তম্ভি, ৬) দ্বিতীয় সাতকর্ণী, ৭) লম্বোদর, ৮) অপিলক, ৯) মেঘস্বাতী, ১০) স্বাতী, ১১) স্কন্দস্বাতী, ১২) মহেন্দ্র সাতকর্ণী, ১৩) কুনতলা সাতকর্ণী, ১৪) তৃতীয় সাতকর্ণী, ১৫) প্রথম পুলমায়ী, ১৬) গৌরা কৃষ্ণ, ১৭) হালা, ১৮) মণ্ডলাকা, ১৯) পুরেন্দ্রসেনা, ২০) সুন্দর সাতকর্ণী, ২১) চক্র সাতকর্ণী, ২২) শিবস্বতী, ২৩) গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী, ২৪) বশিষ্ঠীপুত্র দ্বিতীয় পুলমায়ী, ২৫) শিবশ্রী সাতকর্ণী, ২৬) শিবস্কন্দ সাতকর্ণী, ২৭) যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী, ২৮) বিজয়া সাতকর্ণী, ২৯) চন্দ্রশ্রী সাতকর্ণী, ৩০) তৃতীয় পুলমায়ী।।

গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী:

  • প্রথম সাতকর্ণীর মৃত্যুর একশো বছর পড়ে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী (১০৬-১৩০ খ্রিঃ) সিংহাসনে বসেন।
  • এই সাতকর্ণী ছিলেন সাতবাহন রাজ পরিবারের গৌতমী নাম মহিষীর পুত্র। এই কারণেই তিনি গৌতমী সাতকর্ণী নামে পরিচিতি লাভ করেন।
  • তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর মা গৌতমী বলশ্রী তাঁর কীর্তিমান পুত্রের যশোগৌরবের বিবরণ দিয়ে নাসিক প্রশস্তি রচনা করেন।
  • গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী সাতবাহন বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন।
  • নাসিক প্রশস্তিতে তাঁকে ‘সাতবাহন-কুল-যশ: প্রতিষ্ঠানকর’ অর্থাৎ সাতবাহনদের যশ প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়েছে।
  • গৌতমীপুত্র নিজেকে ‘ত্রি-সমুদ্র-তোয়-পীত-বাহন’ অর্থাৎ যাঁর সেনাদল তিন সমুদ্রের (আরব সাগর, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর) জল পান করেছে বলে অভিহিত করেছেন।
  • ব্রাহ্মণ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও বৌদ্ধদের প্রতি তিনি উদার ছিলেন।
  • তিনি ‘বর-বরণ-বিক্রমচারু-বিক্রম’ উপাধি ধারণ করেন।
  • গৌতমপুত্র সাতকর্ণী ভারতের বর্তমান দাক্ষিণাত্য মালভূমি অঞ্চলে সাতভাহন সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন ।
  • তিনি শক, গ্রিক ও পহ্লবদের শক্তি খর্ব করেছেন বলে দাবি করেছেন । তিনি শক ক্ষত্রপ নহপানকে পরাজিত করে রৌপ্যমূদ্রা থেকে তাঁর নাম অপসারিত করে নিজের নাম খোদাই করেন । তিনি শকদের কাছ থেকে মালব ও কাথিয়াবাড় দখল করে নেন ।
  • নাসিক প্রশস্তি থেকে আরো জানতে পারা যায় যে,পূর্বঘাট পর্বত থেকে পশ্চিমঘাট পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। উত্তরে মালব থেকে দক্ষিণে কানাড়া পর্যন্ত এলাকা তাঁর দখলে ছিল ।
  • ‘ক্ষহরত’ গোষ্ঠীর শক রাজা নহপাণকে তিনি পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু ‘করদমক’ শাখার শাসক রুদ্রদমনের কাছে পরাজিত হন। শকবীর রুদ্রদামন ১৩০ খ্রিষ্টাব্দে সাতকর্ণীকে পরাজিত করে মালব পুনরাধিকার করেন । এই পরিস্থিতিতে শকদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করার উদ্দেশ্যে গৌতমীপুত্র রুদ্রদামনের কন্যার সঙ্গে নিজ পুত্রের বিবাহ দেন ।
  • ১৩১ খ্রিষ্টাব্দে গৌতমী সাতকর্ণী মৃত্যবরণ করেন।

বশিষ্ঠীপুত্র দ্বিতীয় পুলমায়ী

  • ১৩১ খ্রিষ্টাব্দে গৌতমী সাতকর্ণী মৃত্যবরণ করলে, তাঁর পুত্র বশিষ্ঠীপুত্র দ্বিতীয় পুলমায়ী রাজত্ব লাভ করেন।
  • পুলমায়ীর মায়ের নাম ছিল বশিষ্ঠী। সেকারণে তাকে বশিষ্ঠী পুলমায়ী নামে অভিহিত করা হয়েছিল।
  • নাসিক, কার্লে, অমরাবতী প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে তাঁর রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায়।
  • পুলমায়ী রাজত্বলাভের পর অন্ধ্র প্রদেশ জয় করেন। তিনি মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশ অধিকার করেছিলেন। এই সময় মালব এবং কাথিয়াবাড় শকদের রাজা রুদ্রদমনের অধিকারে ছিল। পুলমায়ীর এই আগ্রাসী অভিযানের সূত্রে শকদের সাথে আবার যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। কিন্তু এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই চূড়ান্ত লাভ করতে পারেন নি।
  • পুলমায়ীর রাজধানী ছিল পৈথান।
  • অমরাবতীতে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়, কৃষ্ণা নদীর মোহনা পর্যন্ত তাঁর রাজ্যের সীমা ছিল। ধারণা করা হয় পুলমায়ী ১৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী

  • বশিষ্ঠীপুত্র দ্বিতীয় পুলমায়ীর মৃত্যুর পর শিবশ্রী সাতকর্ণি ও শিবস্কন্দ সাতকর্ণি সিংহাসনে বসেন।। আনুমানিক ১৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এই রাজবংশের শেষ উল্লেখযােগ্য রাজা যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী সিংহাসন লাভ করেন।
  • তিনি পশ্চিমী শক রাজাদের পরাজিত করে, রাজ্যের দক্ষিণাংশ উদ্ধার করেন। তাঁর সময়ে মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশও সাতবাহন রাজ্যের অংশীভূত হয়। ১৯৬ খ্রিষ্টাব্দে যজ্ঞশ্রী মৃত্যুবরণ করেন।
  • তার সামুদ্রিক কার্যকলাপ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের পৃষ্ঠপােষকতার জন্য বাণভট্ট তাকে ত্রিসমুদ্ৰাধিপতি অর্থাৎ তিন সমুদ্রের অধিপতি বলে বর্ণনা করেছেন।
  • যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণীর মৃত্যুর পর, তাঁর রাজ্য সাতবংশীয় বিভিন্ন উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিভাজিত হয়ে যায়। ফলে সাতবাহন রাজ্যের কেন্দ্রীয় শক্তি খর্ব হয়। এই সুযোগে মহারাষ্ট্রে আভিররা স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে। অন্য দিকে ইক্ষ্বাকুরা অন্ধ্র প্রদেশে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে। এই সময় পহ্বব ও ভটকদের ক্রমাগত আক্রমণে সাতবাহন রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়।

সাতবাহনদের সাম্রাজ্যর পতন: যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণির রাজত্বের শেষ দিকে সাতবাহন রাজ্যর পতন শুরু হয়। যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণীর পরবর্তী রাজা বিজয়া সাতকর্ণী ৬ বছর, তাঁর পুত্র চন্দ্রশ্রী সাতকর্ণী ১০ বছর সাতবাহন বংশের এবং শেষ রাজা ছিলেন তৃতীয় পুলমায়ী ৭ বছর রাজত্ব করেন। তৃতীয় পুলমায়ীর মৃত্যুর পরে সাতবাহন সাম্রাজ্য পাঁচটি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত। (১) উত্তর অংশ সমান্তরাল শাখা দ্বারা শাসিত, (২) পশ্চিম অংশ নাসিক অভিরাশ দ্বারা শাসিত, (৩) পূর্ব অংশ কৃষ্ণা-গুন্টুর অঞ্চল অন্ধ্র ইক্ষক্কাস দ্বারা শাসিত, (৪) দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ উত্তর কর্ণাটক, বনভাসীর চুতুস দ্বারা শাসিত, (৫) দক্ষিণ-পূর্ব অংশ পল্লব দ্বারা শাসিত।

  • সাতবাহন শাসনামলে রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রার প্রচলন ছিল।
  • পুরাণে সাতবাহনদের অন্ধ্র বলা হয়েছে এবং এদের বসবাস ছিল গোদাবরী ও কৃষ্ণা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে।
  • তৃতীয় রাজা ছিলেন সাতকর্ণী। তাঁর রানি নায়নিকার অনুশাসনলিপি, নাসিক প্রশস্তি এবং গুণাঢ্য রচিত বৃহৎকথা থেকে এই রাজবংশ সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানা যায়।
  • সাতবাহন সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক।
  • সাতবাহনদের রাজধানী ছিল পৈথান বা প্রতিষ্ঠান নগর।
  • তৃতীয় পুলমায়ীর রাজত্বকালে নাগারর্জুনাকোন্ডা ও অমরাবতীতে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল।